বামপন্থী সাহিত্য-সাংবাদিকতার তুঙ্গবিন্দু আমরা স্পর্শ করেছিলাম সরোজ দত্তের নেতৃত্বেই
- শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
- Sep 19, 2021
- 6 min read
Updated: Sep 30, 2021
১৯৫৯ সালে আমি যখন পার্টির সদস্য পদ লাভ করি, তখন পার্টি থেকে আমাকে পার্টির কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার। এবং স্বাধীনতা পত্রিকার একজন সম্পাদকীয় কর্মী হিসেবে আমি কাজ করি ঐ ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। আর ওই সময়েই আমি বলব যে সাহিত্য-সাংবাদিকতায় আমার প্রথম পাঠ সরোজ দত্তের কাছে। ‘সাহিত্য-সাংবাদিকতা’ কথাটার উপর জোর দিচ্ছি। আমি তখন সাহিত্যের ছাত্র, কলেজে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে উঠেছি। পড়ছি। এবং তার পরে ‘৬১ সালে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি শিক্ষকতা শুরু করি। এই পুরো সময়টা জুড়ে যেমন সাহিত্য বিষয়ে লেখালিখি, পরে থিয়েটার নিয়েও লেখালিখি, শুরু হয়। কিন্তু একটা রাজনৈতিক, বিশেষ করে বামপন্থী, দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্য বা সাহিত্যের স্বাদ কী ভাবে পরিবেশিত হবে, সাহিত্যের কোন কোন খবর এই পাঠক সমাজের কাছে বিশেষ গুরুত্ব দাবী করে, এবং সেই ভাবে লেখা, সেই গুরুত্বটাকে চিহ্নিত করে লেখা এবং গুরুত্বটাকে চিহ্নিত করতে গেলে তার যে পৃষ্ঠপট সেটাকে স্পষ্ট করতে হয়। কারণ সাধারণ পাঠকের কাছে সাহিত্যের গুঢ় অনেক তথ্য, পরিবেশগত অনেক সূত্র এগুলি জানা থাকে না। সেগুলি কীভাবে ধরিয়ে দিতে হয়, কীভাবে একটা অন্য আকারে, অন্য রূপে সাহিত্য সংবাদ পরিবেশিত হয় তার পুরো শিক্ষাটা সরোজদা আমাকে দিয়েছিলেন। উনি তখন রবিবারের পাতার সম্পাদক। এবং আমার অন্য অনেকগুলো কাজের দায়ত্বও ছিল ‘স্বাধীনতা’-য়। তার মধ্যে রবিবারের পাতাতেও নিয়মিত লেখার অবকাশ সরোজদাই করে দিয়েছিলেন।
একমাত্র পার্টিজান সাহিত্যের ইতিহাসই প্রগতি সাহিত্যে ইতিহাস নয়, এই বোধ সরোজ দত্তের মধ্যে কাজ করেছিল এবং এটাকে তিনি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন ‘স্বাধীনতা’য়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতে পারি এবং সেই দৃষ্টান্ত থেকে এটা বেরিয়ে আসবে যে সরাসরি পার্টির কাজে লাগবে তখনই এমন কোনো বিচার বিবেচনা থেকে এই বিষয়ে ভাবা হচ্ছে না এবং ভাবনাটা সরোজদাই ভাবছেন যখন। যেমন ওই সময়ে ডি এইচ লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটারলি’স লাভার’-এর রচনাকাল থেকেই যে সমস্ত মুদ্রণ, সংস্করণ ঘটেছে, তাতে একটা বিরাট অংশ বর্জিত ছিল অশ্লীলতার কারণে, আইন মতেই। এইটাকে অমান্য করে ‘পেঙ্গুইন বুকস’ অবর্জিত ‘লেডি চ্যাটারলি’স লাভার’ প্রকাশ করে তাকে চ্যালেঞ্জ জানান ইংল্যান্ডে, ওই সময়ে। এটা এক দিক থেকে প্রকাশনার ইতিহাসে রাষ্ট্রের খবরদারি, রাষ্ট্রের সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে একটা খুব ঐতিহাসিক ঘটনা। মামলা হয় ‘পেঙ্গুইন বুকস’-এর বিরুদ্ধে। এবং এরা যে বিপুল সংখ্যক কপি ছেপেছিলেন একসঙ্গে, প্রতিবাদী একটা ভূমিকা নিয়ে, সেগুলোকে সরকার তালাবন্দি করে। মামলা ওঠে আদালতে। এবং আদালতের বিচারকালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত লেখকেরা, আইনজীবীরা এই সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে তাঁদের যুক্তি, তাঁদের মত খুব জোরাল ভাবে প্রকাশ করেন। এবং তার পরে শেষ পর্যন্ত আদালত রায় দেয় যে ঐ অবর্জিত, আনসেন্সর্ড ‘লেডি চ্যাটারলি’স লাভার’ প্রকাশিত হবে। তখনও সেই সংস্করণ আমাদের দেশে আইনত এসে পৌঁছয় নি। কারণ, আমাদের দেশে আইনে বাধা তখনও ছিল। অনেক দিন পর্যন্তই ছিল। কিন্তু এইটা একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার হয়ে ওঠে, প্রকাশনার স্বাধীনতার একটা উদ্যোগ, একটা আন্দোলন বলব। ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির তখন যেটা পত্রিকা ‘ডেলি ওয়ার্কার’, তার রবিবারের পাতায় তখনকার খুব বিখ্যাত মার্কসবাদী সাহিত্য সমালোচক, সাহিত্য পণ্ডিত আর্নল্ড কেট্ল, তিনি ‘লেডি চ্যাটারলি’স লাভার’ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এবং সেই প্রবন্ধে প্রকাশ করেন যে ‘লেডি চ্যাটারলি’স লাভার’-এর যে তিনটি ভাষ্য আছে - প্রথম যে ভাষ্য লরেন্স রচনা করেন সেটি তখন প্রকাশিত হয়নি; তার পরে সেটার সংস্কার করে উনি একটা দ্বিতীয় সংস্করণ করেন, দ্বিতীয় ভাষ্য করেন, সেটাও প্রকাশ হয়নি। তার পরে তৃতীয় ভাষ্য প্রকাশের উদ্যোগ নেন, বাধা আসে, তখন ঐ বর্জিত আকারেই সেটা প্রকাশিত হয়। এই তিন ভাষ্যের একটা তুলনামূলক বিস্তারিত আলোচনা করেন। এর আগে - আমি নিজে সাহিত্যের ছাত্র, আমি খুব লরেন্স অনুরাগীও ছিলাম, এখনও আছি - আমি এটার কথা কিন্তু জানতাম না, এই তিনটি ভাষ্যের কথা। ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় ‘ডেলি ওয়ার্কারের’ যে রবিবারের পাতা আসত সেটা সরোজদা বাড়ি নিয়ে যেতেন, দু-তিন দিন রেখে নিজে পড়ে তার থেকে যা কিছু আমাদের প্রাসঙ্গিক হতে পারে, ব্যবহার্য হতে পারে সেগুলি এনে ‘স্বাধীনতা’য় আলোচনা করতেন এবং রবিবারের পাতায় তার থেকে অনেক কিছু প্রকাশিত হতো। ওই প্রবন্ধটি সরোজদা আমাকে অনুবাদ করে দিতে বলেন ‘স্বাধীনতা’ রবিবারের পাতার জন্য। এখানে প্রথাগত বিচারে যদি ভাবা যায়, তাহলে কিন্তু তার মধ্যে অনেক উদ্ধৃতি ছিল, যেগুলো যৌন সম্পর্ক বিষয়ে এবং এখনও সেগুলো অশালীন বা অশ্লীল বিবেচিত হতে পারে অনেকের কাছে। সেগুলো আমরা কিন্তু অবিকল উদ্ধৃতি দিতে পেরেছিলাম মূল লেখাকে অনুসরণ করেই। এবং এই বিরাট প্রবন্ধ - যেটা একই সঙ্গে লরেন্সের সাহিত্যের বিবর্তন, লরেন্সের মতাদর্শগত দিক এবং সাহিত্য সেন্সরশিপের একটা দৃষ্টান্ত - এই সব কিছুকে তুলে ধরেছিল। কারণ, এই তিন ভাষ্যের প্রথম ভাষ্যে এই উপন্যাসের মূল পুরুষ চরিত্র (আমি ইচ্ছে করেই ‘নায়ক’ কথাটা ব্যবহার করব না), সে প্রথমে উপন্যাসের একটা লম্বা অংশ জুড়েই অভিজাত, ধনী লেডি চ্যাটারলির প্রেমিক। কিন্তু তার পরে এই সম্পর্কটা যখন ভেঙে যায়, সে চলে যায়, শেফিল্ডের একটা কারখানায় যোগ দেয় এবং সেখানে সে ইয়াং কমিউনিস্ট লিগের সদস্য হয়। এর পরে একটা সময়ে সে ফিরে আসে দেখা করতে লেডি চ্যাটারলির সাথে। চ্যাটারলি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন যে তাঁদের পুরনো প্রেমের যৌন তৃপ্তির স্মৃতি তাঁকে আকর্ষণ করে কি না, টানে কি না তখন একটু নীরব থেকে এই চরিত্রটি বলে, কমিউনিজম আমার মধ্যে একটা বিদ্যুৎ প্রবাহের মত সঞ্চারিত হয়, সেটা আমাকে এমন উদ্দীপ্ত রাখে যে অন্য কিছু আমাকে আর টানে না। উপন্যাসটির যৌনতা, রাজনীতি, লরেন্সের সাহিত্য প্রতিভা সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা কিন্তু ‘স্বাধীনতা’পত্রিকায় আমরা প্রকাশ করেছিলাম, পূর্নাঙ্গ আকারে, সরোজদার উৎসাহে। পরবর্তীকালের আরেকটা ছোট্ট ঘটনা বলি এই প্রসঙ্গে, সরোজদাও তার সঙ্গে যুক্ত। এই লেখাটা বেরনোর পরে, কিছুদিন পরে আমি কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে দাশগুপ্ত’র দোকানে একটা পুরনো পেপারব্যাক সংস্করণ পেয়ে যাই, খুবই বিবর্ণ, ধুলি লাঞ্ছিত অবস্থায়। লেডি চ্যাটারলি-র প্রথম ভাষ্যের একটা সংস্করণ! সেটা পরম উৎসাহে এনে আমি সরোজদাকে দেখাই। আর ইতিমধ্যে আমার সহপাঠিনী বন্ধু গায়ত্রী স্পিভাক, তখন ও স্পিভাক নয়, চক্রবর্তী, সে আনসেন্সর্ড যে সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল তৃতীয় ভাষ্যের তারও একটা কপি কোথাও থেকে যোগাড় করেছিল, সেটা আমাকে ও পড়তে দেয়। তখন সরোজদা পরম উৎসাহে আমাকে বলেন যে, “এবার তুমি ঐ দুটো ভাষ্য তুলনা করে একটা প্রবন্ধ লেখ ‘স্বাধীনতা’র জন্য। সেটাও আমি লিখেছিলাম এবং প্রকাশিত হয়েছিল।
সরোজদার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এবং বিশেষ করে এই রবিবারের পাতার কাজের মধ্যে আরও অনেক লেখা উনি আমাকে লিখবার দায়িত্ব দিয়েছেন, কখনও অনুবাদ করতে দিয়েছেন, বা অন্য পাতার জন্যেও সাহিত্য সম্পর্কিত, সাহিত্যসংশ্লিষ্ট খবর এবং খবরের সঙ্গে অন্য তথ্য সংযোজনা করে লেখার দায়িত্ব অনেক বারই দিয়েছেন। তার মধ্যে যেটা লক্ষ্য করতাম, আমি আজকে আলোচনা যেখান থেকে শুরু করেছি সেখানে যদি ফিরে যাই, যে সাহিত্য সাংবাদিকতার, বিশেষ করে বামপন্থী সাহিত্য সাংবাদিকতার একটা চরিত্র, একটা স্বরূপ, সেটা সরোজ দত্তের কাছে খুব স্পষ্ট ছিল এবং সেই, বলতে পারি একটা সাহিত্য দর্শন, সেটা তিনি অনুসরণ করতেন। এবং তার মধ্যে হুবহু অনুবাদের দায় যেমন পালন করছেন, অনুবাদে কোনো বিকৃতি বা অনুবাদে আমাদের কোনো মতামত জোর করে অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টাকে অত্যন্ত অন্যায় বলেই মনে করতেন সরোজদা। সেই শিক্ষাই আমাদের দিয়েছিলেন যে অনুবাদ খুব মুলানুগ হবে, নিষ্ঠাবান হবে। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু যে পাঠক সমাজের জন্য আমি কাজ করছি, সেটাকে মাথায় রাখা আমাদের দরকার। কারণ এটা সাহিত্য-সাংবাদিকতা, এটা সাহিত্যের মূল্যায়ন, সাহিত্যের শিল্পমূল্যকে প্রতিষ্ঠা করার শুদ্ধ কোনো প্রয়াস নয়। সেইটা মনে রাখলে রোম্যাঁ রোলাঁর লেখা ‘আই উইল নট রেস্ট’ বইটার স্বরূপটাকে ধরতে সরোজদার অনুবাদে ‘শিল্পীর নবজন্ম’ নামটা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। সমাজবোধের, সচেতন সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিল্পীর যে নবজন্ম ঘটে, সেইটাই কিন্তু এখানে রোলাঁর বিষয়বস্তু ছিল। এবং এই প্রেক্ষিতকে ধরিয়ে দেওয়ার দায় কিন্তু একজন বামপন্থী সাহিত্য-সাংবাদিকের। এটাও সরোজ দত্তের শিক্ষা বলেই আমি মনে করি।
একটা লেখার কথা আলাদা করে বলি, সেটা রোববারের পাতা নয়, রোজকার পাতায় বের হয়েছিল। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঐ সময়টাতে আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধ তার একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এবং সেই মুক্তিযুদ্ধে ফরাসী লেখক বুদ্ধিজীবীরা যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রায় সেই আন্দোলনের পুরভাগে চলে এসেছিলেন ফ্রান্সে। এবং তাঁদেরও নেতৃত্বে এসে দাঁড়িয়েছেন সার্ত্র। এই সময়ে সার্ত্র খুব অল্প সময়ের জন্য ইটালিতে গেছেন, যখন তরুণ দার্শনিক এবং সার্ত্রের সাক্ষাৎ ছাত্র ফ্রাঁসিস জঁসঁকে ফরাসী সরকার বন্দি করে। কারণ তাঁর মাধ্যমে অস্ত্র পাচার হচ্ছিল আলজিরিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। বামাল তিনি ধরা পড়েন। তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়, আদালতে তোলা হয়। সার্ত্র তখন দেশের বাইরে, ইতালিতে। তিনি তক্ষুনি দেশে ফিরে আসতে চান, নিজে আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিতে চান জঁসঁকে সমর্থন করে। ফরাসী সরকার ইতালিতে ওঁর পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয় জোর করে, যাতে উনি দেশে ফিরতে না পারেন তখন। তার প্রতিবাদে সার্ত্র ইতালিতে আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কাছে একটি বিবৃতি দেন, খুব ঐতিহাসিক সে বিবৃতি এবং অসাধারণ তার ভাষার দাহ ও ঔজ্জ্বল্য, যাতে তিনি বলেন যে এক একটা সময় আসে যখন দেশদ্রোহ জাতীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, জাতির কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। “When treason is duty” এই শিরোনামে বিবৃতিটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এর সমর্থনে শতাধিক শিল্পী, বুদ্ধিজীবী তাঁরা একটা বিবৃতিতে সাক্ষর করেন সার্ত্রের বিবৃতিকে অবলম্বন করে। সার্ত্রের যে বিবৃতি, সেটা আমাকে অনুবাদ করতে দেন সরোজদা। এদেশের কোনও কাগজেই কিন্তু ওই বিবৃতি বেরোয় নি। ‘ডেলি ওয়ার্কার’-এ বেরিয়েছিল, সেখান থেকে আমাকে তুলে দেন এবং তার পর যখন অন্য বুদ্ধিজীবী, শিল্পীরা বিবৃতি দেন, সেটা আরেকটু দীর্ঘতর বয়ান ছিল, সেটাও সরোজদা আমাকে দিয়ে অনুবাদ করান এবং ‘স্বাধীনতায়’ প্রকাশিত হয়। তাই কোথাও এটা শুধু আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ফরাসী শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদী ভূমিকার স্বীকৃতি বা প্রচার নয়, তার সঙ্গে কিন্তু আরও মৌলিক প্রশ্ন অর্থাৎ 'দেশদ্রোহ' শব্দের তাৎপর্য, রাজনীতিতে দেশবৈরিতা, দেশবিদ্বেষের আবহের মধ্যে দেশদ্রোহের তাৎপর্য, নিয়ে প্রশ্ন তোলা (যা আজকে ওয়রওয়রা রাও বা স্ট্যান স্বামীর ঘটনাপ্রবাহে এদেশেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে), এই জায়গাটা কিন্তু যখন আমরা তথ্যকে, সংবাদকে যখন তুলে ধরতে পেরেছিলাম, তখন, আমি আবার ঐ কথায় ফিরে যাচ্ছি, বামপন্থী সাহিত্য সাংবাদিকতার একটা তুঙ্গবিন্দু আমরা স্পর্শ করছি - সরোজদার নেতৃত্বে, ওঁর মননের স্পর্শে। যে সরোজ দত্ত বুদ্ধদেব বসু বা সময় সেনের সমালোচনায় ক্ষমাহীনভাবে মার্কসবাদকে একমাত্র কষ্টিপাথর হিসাবে রাখেন, আর যে সরোজ দত্ত আমাকে দিয়ে কোয়েস্টলারের অতীন্দ্রিয় সভ্যতা নিয়ে হলডেনের ক্রিটিক অনুবাদ করান, ‘লেডি চ্যাটারলি’স লাভার’ সম্পর্কে লেখান বা বায়রনের ‘এজ অফ ব্রোঞ্জ’-এর অংশ নিজে অনুবাদ করে আমার লেখার সঙ্গে প্রকাশ করার জন্য নিজের হাতে সুচিন্তিত পেজ লে-আউট করেন - সে দুজনের মধ্যে কোনো স্ববিরোধ নেই। স্ববিরোধ নেই এই কারণেই যে, আমি অন্তত যেটা মনে করি, যেভাবে আমি মার্ক্সবাদকে দেখেছি, বুঝেছি, চিনেছি, জেনেছি তাতে মার্ক্সবাদ কিন্তু একটা কোনো শাস্ত্র নয়, কোনো পুরাণকথা নয়, সেটা একটা জীবন্ত সমাজদর্শন। অর্থাৎ, সমাজের পরিবর্তন, রূপান্তর - সেটা কখনও থেমে থাকে না। এবং তার সঙ্গে বামপন্থী রাজনীতি, তার ভূমিকা- দলগত ভূমিকা, দলের বাইরে ভূমিকা- এই ভূমিকাগুলোও অব্যাহত থাকে। এবং অন্তত আমাদের বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসটাই, প্রথমত খুব জটিল রাজনৈতিক-সামাজিক প্রক্রিয়া। তার সঙ্গে বামপন্থী চেতনার, বামপন্থী আন্দোলনের অব্যাহত একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, দ্বান্দ্বিক সংযোগ- সেই ইতিহাস। সেই ইতিহাসে এক একটা সময় এক একটা কালপর্ব হয়ে সাহিত্যকে কী দৃষ্টিতে দেখা হবে, সাহিত্যকে কী ভাবে এই আন্দোলনের পঞ্জিভূত করা যাবে, কী সম্পর্ক হবে সাহিত্যের সঙ্গে আন্দোলনের- এই চিন্তাটা কিন্তু আবর্তিত হবে। সরোজ দত্তের এই বোধটা ছিল।
'জাতিপ্রেম', 'দেশপ্রেম' এই শব্দগুলোকে খেলিয়ে ফ্যাসিবাদ আজকে তার নখর দিয়ে বিদ্ধ করছে আমাদের চেতনা ও বোধকে। বামপন্থী সাহিত্য-সাংবাদিকতার এই ক্ষেত্রটাকেও তত্তত্বগত ভাবে আরও প্রসারিত করার এবং প্রয়োগ করতে পারার একটা বিশেষ গুরুত্ব আজকে আবার দেখা দিয়েছে। সেখানে সরোজদা আমার নেতা এখনও।
Comments